প্রত্যাশার নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন হোক নতুন বছর

0
1704

আলী প্রয়াস

দেয়ালে ঝুলছে আরেকটি নতুন ক্যালেন্ডার। স্মৃৃতির খেরোখাতা থেকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মুছে শুরু হলো নতুন বছর। সেই সাথে অনেক ঘটন-অঘটন, চড়াই-উৎরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে থাকলো সদ্য বিদায়ী বছরটি। সেইন্ট গ্রেগরি প্রবর্তিত ক্যালেন্ডারের হিসাবে যাত্রা করলো ২০১৬। নতুন দিনের নতুন সূর্যকে বরণ করেছে বিশ্ব। স্বাগতম, নতুন বছরকে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালিও মেতে ওঠে ইংরেজি নববর্ষ বরণের আনন্দে। নতুন খ্রিস্টাব্দের সূচনামুহূর্ত নিয়ে উচ্ছ্বাস-উল্লাস বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব কোন অঙ্গ না হলেও পাশ্চাত্য-প্রভাবে শহর-নগর, গ্রাম-বন্দরসহ সারা দেশে এর ব্যাপ্তি ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে। পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করার উৎসবে সারা বিশ্বের একাত্মতা বিশ্ববাসীকে একটু হলেও এক সুতায় গেঁথে রাখে। বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ পালনের ধরন বাংলা নববর্ষ পালনের মতো ব্যাপক না হলেও এ উৎসবের আন্তর্জাতিক ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশের মানুষও বিচ্ছিন্ন নয়। ক্রমশ এই উৎসব আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

সময় এক প্রবাহমান মহাসমুদ্র। তাই তো জীবন এত গতিময়। কেবলই এগিয়ে যাওয়া। তবু চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ধূসর হয়ে আসা গল্পগাঁথার সারি সারি চিত্রকল্প। কখনো বুকের ভেতর উঁকি দেয় একান্ত দুঃখ-যাতনা। কখনো পাওয়ার আনন্দে নেচে উঠে হৃদয়াঞ্চল। হতাশা-গ্লানি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সব হিসাব-নিকাশ কালের অতল গহ্বরে বিলীন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যাপক প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করল এ বছর। বিগত বছরে আমাদের অনেক অর্জন ও প্রাপ্তির পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিল। স্বাদ আর সাধ্যের টানাপড়েনের কারণে হয়তোবা আমাদের অনেক প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়নি। তবু আপন তাৎপর্যে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে বিগত বছরটি। মানবসভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রসরমানতায় কিছুই হারিয়ে যায় না, অতীতের সব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে আগামীর পথ ও পাথেয়। বিদায়ী বছর আমাদের চেতনা জাগ্রত করার পাশাপাশি আহ্বান করে গেল নতুন সম্ভাবনায় বলিষ্ঠ যাত্রী হিসেবে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার।

কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ২০১৫ সাল নানা ঘটনায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে। বছরটি জুড়ে শান্তির সুবাতাস বয়ে গিয়েছিল এমনটা বলা যাবে না। আইএস, বোকো হারাম ইত্যাকার উটকো ঝামেলা রক্ত ঝরিয়েছে, প্রাণহরণ করেছে; করেছে বড় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ। তারপর দেশ-বিদেশে শরণার্থী সমস্যা তো ছিলই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও যে খুব সুবিধাজনক ছিল তা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও ঘটেছে মৌলবাদী, ধর্মান্ধ শক্তির হামলা, নাশকতা। যদিও বছরের অধিকাংশ সময় ক্ষমতাসীন দলের কৌশল ও বিচক্ষণতায় রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল স্থিতিশীল। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। অর্থনীতি থাকে সচল ও গতিময়। কিন্তু মুক্তচিন্তা চর্চাকারীদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় জনমনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। পাশাপাশি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের চূড়ান্ত রায় প্রদান ও কার্যকর হওয়ায় দেশের মানুষ আনন্দিত। ফলে শেষ দিনটি যখন গোধুলিতে, তখনও হাসছিল বাংলাদেশ।

একটি বছরের বিদায় কেবল আনন্দের বিষয় হতে পারে না। বরং এটি আমাদের চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার মোক্ষম উপলক্ষ্য বৈকি। আমরা বিগত বছরটি কীভাবে কাটিয়েছি, আগামী বছর কীভাবে কাটাব এবং এ বছরে আমাদের অর্জন কী কী? এর সাথে আরও নানা প্রশ্ন ঘিরে ধরা উচিত আমাদের চেতনা জগৎকে। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার কারণ অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ধর্মান্ধ চিন্তা-চেতনা, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা, আমাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, সর্বোপরি আমাদের আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে তৎপরতা তা প্রতিরোধে নতুন বছরে দেখতে চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ। একটি জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা হলো তার মূল্যবোধ, চিন্তা, চেতনা, যুক্তিবোধ ও বিশ্বাস। আশা করি সেই বিশ্বাস যারা ধ্বংস করতে চায় তার বিপক্ষে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের বছর হবে এটি। সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের যে অবস্থা চলছে তা আমাদের সাংস্কৃতিক সংকট। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো হলো সংস্কৃতির বস্তুগত দিক, যার সমাধান করতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের প্রয়োজন চিন্তার মুক্তি। চিন্তার মুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সৃষ্টি, দেশব্যাপী নতুন করে জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াস নিতে হবে। সে জন্যই বছরের শুরুতে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন প্রত্যাশা করেন, ‘যুক্তিভিত্তিক, জ্ঞান সমৃদ্ধ, মানবিক সমাজ চাই। জঙ্গিবাদ, কুসংস্কার, মৌলবাদ থেকে সমাজ ও তরুণ প্রজন্ম মুক্তি পাক। প্রতিটি শিশু যেন তার ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ করতে পারে তেমন পরিবেশ তৈরি হোক।’

স্বাভাবিকভাবেই নতুন দিনে আমাদের আশা অনেক, প্রত্যাশাও ব্যাপক। তবু স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। কেননা সে স্বপ্নই হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে! আমরা স্বপ্ন নিয়েই এগোতে চাই। চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও তাতে ভোগান্তি ব্যতীত সাধারণ মানুষের তেমন প্রাপ্তি নেই। আমরা চাই স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণের প্রত্যাশা, আবেগ ও অনুভূতিকে যথাযথ মূল্যায়ন করে শহরের যানজট, জলাবদ্ধতা, নিরাপদ পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ অন্য হাজারো সমস্যার সমাধানে গুরুত্ব দিবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য নতুন বছর এলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, নগর প্রশাসকরা নানা উন্নয়ন ও সম্ভাবনার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও বছর শেষে সাধারণ নাগরিকের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। তাই আবারো বলতে চাই, ২০১৬  শুধু প্রত্যাশার নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নের বছর হোক। নামে নয়, কার্যত এক বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম দেখতে চাই।

যে নতুন বছরের সকাল হলো আজ। অরুণোদয়ের সে সকাল আরও উজ্জীবিত দিন এনে দেবে জাতিকে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সবপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। বিশ্ব শান্তি ও বিশ্বমানবতা সমুন্নত থাক। মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাক। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বিদায়ী বছরের অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দেশ গড়ার কাজে ব্যয় করে নতুন বছরে উন্নয়ন-অগ্রগতির নবদিগন্তে প্রবেশ করুক বাংলাদেশ। আমাদের প্রত্যাশা বিদায়ী বছরের যাবতীয় ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সকলেই বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একযোগে কাজ করবে।

সকল নাগরিকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের গণমাধ্যমকে অধিক শক্তিশালী করতে হবে। বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার আইনগত অধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

জাতি হিসেবে আমাদের ভালো কিছু অর্জন আছে। সেই মহৎ অর্জন ও ধারাবাহিক সাফল্যের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়েও যাচ্ছে উত্তরোত্তর। তাই নাগরিক হিসেবে নতুন বছরের প্রতিটি দিনই যেন ভালো ও শুভ কাজের মাধ্যমে দেশ ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারি এমনটিই প্রত্যাশা আমাদের। নতুন বছরের কাছে প্রত্যাশা ভালো থাকার, সুন্দর থাকার। মানুষে মানুষে বাড়–ক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা। নতুন বছর হোক সত্যিকার অর্থে দিনবদলের ইতিবাচক বছর। শুভ হোক ২০১৬’র পথচলা। সবাইকে খ্রীষ্টিয় নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

আলী প্রয়াস : কবি ও সম্পাদক, তৃতীয় চোখ।

thirdeyecox@gmail.com