আজ কলঙ্কময় ‘পিলখানা হত্যা’ দিবস

0
1191

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো মঙ্গলবার। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী (বিডিআর) বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পিলখানায় কিছু বিপথগামী জওয়ানের বিদ্রোহে ৭৪ জন নিহত হন। এদের মধ্যে ৫৭ জনই ছিলেন সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এর আগে, দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নিহত হননি। এই ঘটনা দেশে-বিদেশে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে।

বিচার
পরবর্তীতে এ ঘটনায় বিডিআর (পরিবর্তিত নাম বিজিবি) আইনে একটি এবং ফৌজদারি আইনে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়। বিদ্রোহের মামলায় আসামি করা হয় ৬ হাজার ৪৬ জনকে। আর হত্যায় ৮৫০ জন এবং বিস্ফোরক ব্যবহারে ৭৮৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
দু’টি বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিদ্রোহের বিচার শুরু হয়। বিদ্রোহের ঘটনায় ১৯৭৪ সালের বিডিআরদের নিজস্ব আইন (বিডিআর অ্যাক্ট) অনুযায়ী দেশব্যাপী তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৭ হাজার ৩০৬ জন বিডিআর জওয়ানকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
ওই সময় ১১টি বিডিআর কোর্টে বিডিআর অ্যাক্টে দেশব্যাপী ৫৬টি মামলা হয়। এ মামলায় মোট ৬ হাজার ৪৬ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে চার্জশিটভুক্ত মোট ৫ হাজার ৯২৬ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়। এসব মামলায় পাঁচজন বিডিআর জওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। বিচারে বিডিআর অ্যাক্ট অনুযায়ী নূন্যতম শাস্তি ছিল চার বছর কারাদণ্ড ও একশ টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড।
একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধের জন্য লালবাগ থানা ও নিউমার্কেট থানায় পৃথক মামলায় বিচার কাজ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ চার বছরের বিচারকার্য শেষে গত ৫ ডিসেম্বর বিচারক ড. মো আক্তরুজ্জামান কাঙ্ক্ষিত রায় দেন। রায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি আরো ৪২৩ জনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এদের মধ্যে ২ জন আসামিকে যাবজ্জীবন, ১৫৮ জনকে যাবজ্জীবনসহ ৪০ বছর কারাদণ্ড ও ২৬৩ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে তাদের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। একই সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তাদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের পেপার বুক তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এরপর আপিল শুনানি শুরু হবে।
ফিরে দেখা
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা। বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ দরবার হলে প্রবেশ করেন। তার কাছে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হক প্যারেড হস্তান্তর করেন। তারপর ডিজি ও ডিডিজি মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠান শুরুর পর ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কার্যক্রম প্রসঙ্গে কথা বলেন ডিজি শাকিল আহমেদ। এ সময় তিনি জানতে চান, ডাল-ভাতের দৈনিক ভাতা সৈনিকরা ঠিকমত পেয়েছে কিনা। কিন্তু সৈনিকদের জবাব জোরালো ছিল না। এরপর ডিজি ডাল-ভাতের কিছু হিসাবের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। এ সময় হঠাৎ দরবার হলে অস্ত্র হাতে প্রবেশ করেন এক সিপাহী। মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে অস্ত্র তাক করলে পাশের কর্মকর্তারা মইনকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। এরপর স্লোগান গিয়ে দরবার হল থেকে বেরিয়ে পড়ে জওয়ানরা।
এরপরের ঘটনা অত্যন্ত নৃশংস। একের পর হত্যা করা হয় সেনা অফিসারদের। জওয়ানদেন সামাল দিতে আসলে গুলি করে হত্যা করা হয় কর্নেল মুজিব, লে. কর্নেল এনায়েত আর মেজর মকবুলকে।
দরবার হলের ভেতরে অবস্থানরত সেনা কর্মকর্তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে জওয়ানরা। প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক পালিয়ে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে গুলি করা হয়। সব মিলিয়ে হত্যা করা হয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে।
বিদ্রোহের পর পুরো পিলখানায় চলছিল গুলিবর্ষন। সকাল থেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য আর জনপ্রতিনিধিরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। দুপুরের মধ্যে পিলখানার চারপাশে সশস্ত্র অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী।
পরে বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের একটি দল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক করে অস্ত্রসমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা তা করেনি। বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যায় একটি হোটেলে চলে দফায় দফায় বৈঠক। এরপর রাত ১টার দিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল পিলখানার ভেতরে প্রবেশ করে। বিডিআরের কিছু সদস্য অস্ত্রসমর্পণ করেন। ভোরের দিকে কয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার করেন তারা। অবশ্য, তখনো থেমে থেমে চলছিল গুলিবর্ষণ।
পরদিন সকাল থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় পিলখানায় আটকে পড়া মানুষদের। দুপুরে বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ করতেই চারপাশে অবস্থানরত সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে ভেতরে। সঙ্গে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ পিলখানা থেকে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
বিডিআর থেকে বিজিবি
ওই বিদ্রোহের ঘটনার পর ২০১০ সালে বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয় এবং এ জন্য একটি আইন করা হয়। এই আইনে বিজিবির জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়। আগে বর্ডার গার্ড আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও নতুন আইনে বিধান রাখা হয় মৃত্যুদণ্ডের।