আমাদের বিলুপ্ত খেলাধুলা -আবদুল হাই

0
1203

এক কালে খেলাধুলা ছিলো লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্দ অংশ, নগরায়ণের মাধ্যমে অনেক খেলাধুলা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ সমস্ত খেলাধুলার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে একটা সেতু বন্ধন নির্মিত হয়েছিলো, তা এখন নিষ্ঠুরভাবে ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশের কিঞ্চিত পরিমাণ জায়গা নিয়ে দুটি নগর ঢাকা-চট্টগ্রাম বাদে বিস্তৃর্ণ এলাকায় ছিলো গ্রাম ভিত্তিক সংস্কৃতির পর্যায়ভুক্ত এখনতো শহরের বিস্তৃতি পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই শহর-গ্রামকে আলাদাভাবে দেখার অবকাশ নেই। ধরতে গেলে বাংলাদেশ এখন গ্রাম প্রধান দেশ নয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে শিশু কিশোর যুবকদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ ছিলো। প্রত্যেক বাড়ি-ঘর ছিলো খোলামেলা। প্রত্যেকের বাড়ির পাশে প্রশস্ত উঠোন, কাচারিঘর বা বহিরাগতদের জন্য বৈঠক খানা; ঝোপঝাড়, ফলমূলের গাছ ও সুপারী, নারিকেলের গাছ। প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। খোলা আঙ্গিনায়, কিংবা ধানক্ষেতের খোলা মাঠে কিশোর-কিশোরী ব্যস্ত থাকতো হরেক রকম খেলাধুলা নিয়ে। দেশের শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত ছিলো কাবাডি, গোল্লাছুট, লুকোচুরি, এক্কাদোক্কা, ডাংগুলি, মার্বেল, নোনতা, লাঠি খেলা, পুকুর খেলা; চাকুকাটা, চাঁকা খেলা, সিকুৎ কুৎ খেলা, বৃষ্টি মাঙ্গা, তাস খেলা, লুডু খেলা, পাশা, দাবা, বাঘচাল, ছয়গুটি ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রায় পরিবার যে স্বচ্ছল ছিলো এমনটা নয়। আর্থিক বিচারে সবাই সমপর্যায়ের টানাপোড়েনে দিন কাটতো। তাই সবার মাঝে সৌহার্দের ভাব দৃষ্টিগোচর হতো। বিদ্যালয়ের পাঠ ও দুপুরের ভোজনান্তে আমরা বন্ধু-বান্ধবরা বেড়িয়ে পড়তাম খেলাধুলার উদ্দেশ্যে। মার্বেল খেলাকে, চাঁটগাঁর ভাষায় বলা হতো লেলিখেলা। লেলিখেলায় আমার কিশোর বয়সের বান্ধবী-জবেদা অত্যন্ত পটু ছিলো। ও পপলীন কাপড়ের লুঙ্গি আর গায়ের কাপড় পড়তো। আমার কৈশোরের এ বান্ধবীকে আজো ভুলিনি। সাক্ষাতে অতীত স্মৃতি রোমঞ্চন করি, ও মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। লেলিখেলা ৩ প্রকারে খেলা হতো। যেমন – টোক্কা, লেপচি আর হাতে মধ্যমা আঙ্গুলের টোকা দিয়ে খেলা, তিন ক্ষেত্রে জবেদা সবসময় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে খেলতো, দেখতে দেখতে নিমিশে তার লুঙ্গির কোঁচ্চা মার্বেলে ভারি হয়ে ওঠতো। তাকে হাজার রকমে নজর দিয়েও কাবু করা দুরুহ ছিলো। বলতাম “জক্কির হাতোত ফৈইজ্জে ধান-চৈইল মহঙ্গা হইয়ে” ও আঙ্গুলে থু থু লাগিয়ে আমার গায়ে স্পর্শ করতো। নজর কেটে যেতো, ঠিক খেলা নামের একপ্রকার খেলার প্রচলন ছিলো। মেয়েরা বেশী খেলতো, মুরুব্বিরা ঠিক খেলতে নিষেধ করতো। তারা বলতেন ঠিকে ভিক্ষক, অর্থাৎ ঠিক খেললে দারিদ্রতা নেমে আসবে, কে শুনে কার কথা। ভোতা ধরনের বোল্ডার পাথর দিয়ে খেলা হতো ঠিক খেলা। ওতে কিছু ছন্দবদ্ধ বুলি আউড়ানো হতো। অতীত স্মৃতিতে পাঠকদের জন্য এর কিছু উপস্থাপন করলাম যেমন

১.

“চাকু বেটা পানের বাটা,

চাকু দুই খেলে দুই,

চাকু তিন ঘোড়ার ডিম,

চাকু চাইর বদা চার

পঞ্চচুটি কানারে বরো

২.

অবড় অবড় – দুই – দু গুনা চাইর

অবড় অবড় – তিন – দু গুনা ছয়

অবড় অবড় – চার – দু গুনা আট

ইত্যাদি কাব্যিক ছন্দে বুলি আউড়িয়ে খেলাটা জমিয়ে উঠতো। ঠিক খেলার অস্তিত্ব আর নেই হয়ত; স্মরণে নেই কারো।

আবার দিন দুপুরে পাড়া-মহল্লার কিশোর-কিশোরীদের কাছে আর একটা খেলার প্রচলন ছিলো। সে খেলাকে কিছু কাব্যিক ছন্দের বুলি আউড়ানো হতো- যেমন-

“ডেরাম ডেরাম বাইশ কোপ

রাইতে দিনে তেইশ কোপ

চুলটানা বেবী আনা

চাইরাত বাবুর বৈঠকখানা

ইস-রেতে খেতে পানশুপারী পেতে

পানের আগা মরিচ বাটা

সাইক বাবুর বৈঠকখানা….. ইত্যাদি ছন্দবন্ধ কাব্যিক শ্লোকের ভাবার্থ বোধগম্য না হলেও দারুণ উপভোগ্য ছিলো। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং নগরায়নের অভিশাপে এ সব ছন্দবদ্ধ শ্লোকের মাধ্যমে এ সব খেলা গ্রাম বাংলার আর কোথাও দেখা যায় না।

আমাদের দেশীয় খেলা মধ্যে হা-ডু-ডু ছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। গ্রামাঞ্চলে প্রশস্ত মাঠে জমে উঠতো হা-ডু-ডু। এ খেলাতে ছন্দবদ্ধ বুলি আউড়িয়ে খেলা হতো। যেমন – তোর বাড়িত গেলাম রে, তোরে ন ডরাই, তোর বাপের গদা লই তোরে দুরাই, তোরে দুরাই………. প্রতি পক্ষকে ছুঁয়ে আসতে পারলেই হয়। কাবাডি খেলা ২ প্রকারের, কোটবন্দী ও চার কাবাডি। কোট বন্দী ও চার কাবাডি প্রায় একই ধরনের। পার্থক্য হচ্ছে কোট বন্দীর মধ্যে কোট থাকে, চার কাবাডির মধ্যখানে দুই দলের জন্য পার্থক্য রেখা থাকে। একপক্ষ অন্যপক্ষের পার্থক্য রেখা অতিক্রম করলে প্রতিপক্ষের সবাই তাকে সজোড়ে আঠকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। ঐ পক্ষ সবার শক্তিকে মোকাবিলা করে নিজেদের সীমানায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে এ খেলায় যথেষ্ট শারীরিক শক্তি সামর্থের প্রয়োজন হয়।

গ্রাম বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলার মধ্যে ডাংগুলি। এ খেলার জন্য প্রয়োজন একটা এক হাত লম্বা লাঠি যাকে বলা হয় ডাং আর একটি ছোট আকৃতির কাঠের দু’মুখ সুচালো গুলি। দুই পক্ষ খেলায় অংশ গ্রহণ করে। মাটিতে অগভীর লম্বাটে গর্ত করে প্রথমে গুলিটি বসিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ডাং নিক্ষেপ করে লাগাতে পারলে প্রথমে সে খেলবে। এবার ছোট্ট গুলিতে মাটির গর্তে স্থাপন করে ডাং দিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করবে। তারপর ডাং গর্তের মাঝখানে বসিয়ে দিতে হয়। প্রতি পক্ষ যেখানে গুলি পড়েছে ওখান থেকে নিক্ষেপ করলে যদি ডাং এ স্পর্শ করে তবে আউট। আর যদি গুলি অন্যত্র পড়ে তবে খেলোয়াড় গুলির সুঁচালো অংশে আঘাত করলে গুলি উপরে ওঠতেই ডাং দিয়ে আঘাত করলে অনেক দূর নিক্ষেপ করে। ওখান থেকে গণনা করা হয়, ডাং দিয়ে অবশ্যই এ সময় এক হাত পেছনে রেখে ডাং দিয়ে গুনতে হবে নচেৎ প্রতিপক্ষ পিঠের ওপর জোড়ে হাত দিয়ে আঘাত করবে। গণনার পদ্ধতি হচ্ছে এ্যারি, দোরি, তেরি, চুরি, চম্পা, জেক, জাম, এ ছিল ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলার ডাং-গুলি খেলা।

এসব লোকজ খেলা বর্তমান চাকচিক্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে অদৃশ্য হয়ে গেছে। গানের তালে তালে লাঠি নৃত্য অথবা লাঠি খেলা, বানাটি ঘোরানো এসব তো এখন আর চোখে পড়ে না। উঠোনের  মার্বেল মেয়েদের চাঁদা খেলা, সেই দুই পক্ষের মধ্যে টুকা টুকি খেলা, সে কাঁনামাছি; সে গোল্লাছুট খেলা যেন অতীতের স্বপ্ন আজ দৃষ্টির অন্তরালে।

বৈশাখে জায়গা জায়গায় বলি খেলার আয়োজন অত্যন্ত উৎসব মুখর ছিলো। ফিরিঙ্গী বাজারের আলী হায়দার আহাং, মাবিনর বলি খেলা এবং জব্বারের বলি খেলা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিলো। বর্তমানে ঐতিহ্য ও পূর্বতন জোঁলুস বজায় রেখে লালদিঘীর মাঠে আবদুল জব্বারের বলি খেলা আজো প্রচলিত আছে।

তখনকার সময়ে খেলাধুলার ফাঁক-ফোকরে স্থান করে নিয়েছিলো খরাতে বৃষ্টি মাগার আয়োজনে। যারা বৃষ্টি মাগতো তাদের একটা বিরাট মিছিল বের হতো, তারা পাড়া মহল্লায় কিশোর যুবকদের নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কাব্যিক ছন্দে বৃষ্টি মাগতো –

আইউরে বড় বাড়ী

বড় বাজীর কুন্দি ঘাঁডা

পত্ দু-আইজ্জ্যা মাদার কেঁডা

মাদার কেঁডা এত বিষ

খাইত ন’ফাইল্যে আঁরে দিস।

যে কয় তোরা তোরা

তার- তে উডোক কেচ্যোয়া ফোড়া

যে কয় আর না

তার মরিবো বুড়া মা

আইউ মুইত্যা যাইবা কই

ঘাঁঢোর তলে বইউ গো।

এরপর মাথার ওপর একজনে গোল চালুন রেখে গুড়তো এর উপর আর অন্য একজন পানি ঢালতো চারিদিকে পানি ছিটকে পড়তো। এটা ছিল বৃষ্টি ডাকার খেলা।

পুকুর খেলা নামের একটা প্রিয় খেলা কিশোর যুবকরা প্রায় খেলতো। মধ্যখানে একজন দাঁড়াতো তাকে বলা হতো মাছি। তার চারদিকে হাতে হাত ধরে গোল করে দাঁড়াতো অন্য সবাই। তাদের গোলাকার অবস্থান পুকুর। পুকুর থেকে পালাবার জন্য মাছ বলতো-ইন্দি যাইয়ুম কোদাল মাইরয়ুম, ইন্দি যাইয়ুম, ফাউরা মাইরজুম, ইন্দি যাইয়ুম কু-রুইল মাইরজ্জুম… ইত্যাদি… মাছ জোড় করে পালিয়ে যেতো। সবাই দৌড়ে তার পিছে ছুটতো।

আমাদের ঐতিহ্য-রীতিনীতি আধুনিক-তার কাছে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। ছেলেবেলা গল্পগুলো এখন কতদূরে অবস্থান করছে! হাজার চেষ্টায় আর ফিরিয়ে আনা যাবে না জানি। সে আনন্দঘন মুহূর্তের ইতি হয়ে গেছে। সর্বত্রই আধুনিকতা, আর আত্মকেন্দ্রিকতা, সময়ের তালে বেতালে সে ঐতিহ্য, সে সাংস্কৃতি, সে সৌহার্দ বন্ধুতে বন্ধুতে আন্তরিকতার স্পর্শে সিক্ত হবে না আর। কোন সুহৃদয় যদি আন্তরিকতা দিয়ে এসব স্মৃতিকে পুস্তকের পত্রে পত্রে বন্ধন করে রাখে কিছু হারিয়ে যাওয়া বিষয়গুলো হয়ত- বা হাস্যরসের খোরাক জোগাবে। সব পুরাতন স্বর্ণময় হউক সংগ্রহের মাধ্যমে।

লেখক: সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক।