একটি ভ্রমণ ও কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা- সৈয়দ হুমায়ূন আহমেদ

0
1100

১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ কোন একদিন আমি আর জনাব আসগর করিম ব্যবসায়িক কারণে ব্যংকক যাত্রা করি। আসগর করিম ভাইয়ের সাথে আমার দীর্ঘকালীন হৃদ্যতার সম্পর্ক। তিনি অতি সদাশয় ব্যক্তি আর উঁচু বংশীয় সুপুরুষ। উভয়ের অফিস আর কারখানা রাস্তার এপার-ওপার তাই অবসর মুহূর্তগুলি বেশীর ভাগ তার অফিসে আড্ডা দিয়ে কাটাতাম। প্রায় দিন আমাকে তিনি তার বাসা থেকে পাঠানো নাশতার ভাগিদার করতে ভুলতেন না। যদি কোন দিন ব্যত্যয় ঘটতো অমনি তার বিশেষ দূত নেহাল সাহেব এসে আমার অফিসে হাজির হতেন, সাব আপকো ইয়াদ কিয়া। ব্যাস! আমার শত কাজ থাকলেও আমি তার সান্যিধ্য পেতে ছুটে যেতাম। তার অফিসে আমাদের আড্ডায় বিভিন্ন সময় দেশের প্রতীতযশা ব্যক্তিদের সমাগম হতো আর সেখানে বসে চা-সিগ্রেট এর ধোঁয়ায় কাজের অবসর গল্প করে কেটে যেত।

নির্দিষ্ট দিন আসগর ভাইয়ের গুলশানের বাসা থেকে আমি তাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট রওয়ানা দিলাম। আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুরের দিকে আর আমরা সেদিন অপরাহ্রে যথারীতি ব্যংকক পৌঁছলাম। আগে থেকে নির্বাচিত কোন এক ভারতীয় শিখ ভদ্রলোকের মালিকানাধীন হোটেলের একটি রুমে উভয়ে থাকার জন্য উঠলাম। সেই হোটেলের খোঁজ দিয়েছিলেন দেশীয় সেই আড্ডার কোন এক ব্যক্তি। হোটেলটির তখনও সম্প্রসারণ কাজ চলছিল তবে বেশ পরিপাটি আর ছিমছাম পরিবেশে আমাদের ভালোই লাগছিল। শিখ সর্দারজীর সুযোগ্য পুত্র ‘চেরী’ আমাদের দেখভালের দায়িত্ব নিলো এবং তার পরিচালিত ট্যুর’ কোম্পানীর বিভিন্ন চমকপ্রদ অফার দিয়ে আগ্রহী করে তুলতে চাইলো। এসব কোম্পানীর বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ঘুরে দেখানো ছাড়াও অন্যান্য আকর্ষণ থাকে যা আমাদের জানা থাকায় আকৃষ্ট না হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিলাম। আসগর ভাই জ্ঞানী আর লাজুক স্বভাবের মানুষ, তাই তার কথাবার্তায় এক মার্জিত রূপ প্রকাশ পেয়ে তার আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। রাতের খাবারের জন্য সন্ধ্যায় হোটেলের বাইরে পা দিতেই এক থাই লোক সামনে এসে তার পকেট থেকে বেশ কিছু ছবি দেখিয়ে আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। আসগর ভাই লজ্জায় সরে দাঁড়ালেন, আমি লোকটিকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম আমরা এসব ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী না। তবুও সে অন্য পকেট থেকে আরো কিছু ছবি খুলে মেলে ধরলো আর থাই ইংলিশ ভাষায় -ভেলি গুদ, ভেলি গুদ বলে বিরক্ত করতে লাগলো। আসগর ভাই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আমাকে বললেন, চলিয়ে, ইয়ে বদমাশ পিছা নেহি ছুড়েগা। আসগর ভাই রাগ করলে উর্দুতে বলেন, লক্ষ্য করেছি। দিস ইজ ব্যাংকক! এভরি বডি ডু নট কাম হিয়ার ফর সেইম বিজিনেস বলেই হাঁটতে লাগলেন। অগত্যা আমিও তার পিছু নিলাম। অন্যান্য বার ব্যাংকক এসে এখানকার দু’চারজন থাই ব্যবসায়ী বন্ধুর সাথে ঘুরাফেরা করি আর সময় কাটাই তবে অনৈতিক কোন ব্যাপারে তাদের কোন উৎসাহ দেখি নাই বা নিজেও আগ্রহ দেখাইনি। রাতের খাবার শেষে হোটেলে ফিরে পরের দিন ‘ভরা চাক’ নামের গাড়ির পার্টস মার্কেটে আমাদের নির্দিষ্ট পার্টস দোকান এর ঠিকানা আর পার্টস এর তালিকা পর্যালোচনা করতে বসলাম, তারপর নামাজান্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ‘ভরা চাক’ মার্কেটে কেনা-কাটার উদ্দেশ্যে বের হলাম। রুমের বাইরে করিডোরের মাথায় বেশ বড় একটি লিফট আর সেখানে জটলা দেখে একটু ধীরে এগিয়ে গেলাম। দু’তিনজন আমেরিকান আর তাদের থাই সহকারী দল সিনেমার ক্যামেরা, স্ট্যান্ড, লাইটস ইত্যাদি লিফটে উঠাতে ব্যগ্র হয়ে আছেন তাই তাদের পিছনে অন্য যাত্রীদের ভীড় লেগে আছে। সবাই নিশ্চুপ অপেক্ষারত আছেন তাদের মালপত্র উঠানো হলে তবে লিফটে চড়বেন। লক্ষ্য করলাম, আমাদের সামনে দু’জন যুবক এই বিলম্ব সইতে পারছিলেন না, তাই বাংলায় ঐ বিদেশীদের লক্ষ্য করে কিছু কাঁচা গালি দিয়ে বসলেন। আমরা হতবাক হলাম, বিদেশে এসেও এসব নব্য ব্যবসায়ী তরুণদের মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলো না, অথচ মানুষ পরিবেশ আর স্থান ভেদে নিজের রুচির সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করে। এই বাঙালিদ্বয় নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলো না। লিফটে চড়ে চুপচাপ নিজের পরিচয় আত্মগোপনের প্রয়াশ নিলাম, ঠিক তখনই একজন আমেরিকান পরিশুদ্ধ বাংলাতে বলে উঠলেন-‘আমরা আন্তরিক দুঃখিত, আপনাদের কষ্ট দিয়েছি। আমরা গতকাল সন্ধ্যায় শুটিং শেষে ঢাকা থেকে এখানে এসে পৌঁছাই, আজ আমাদের এখানে কিছু শুটিং শেষ করে চলে যাব তাই সব যন্ত্রপাতি নিয়ে একবারেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা বাংলা বলতে পারি এবং বুঝি, এতোটা নির্দয় গালাগালি আশা করি নাই। আমরা আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি’।

আমার মনে হলো লিফট ছিড়ে নীচে পড়ে গেলে বেঁচে যাই, নিজেদের পরিচয় দেয়ার মত কোন সাহস আর রইলো না। সেই দুই বাঙালি চুপ হয়ে তাদের কথা হজম করলো অথচ নিজেদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না। হায় বাঙালি! নিতান্ত ভদ্রতা দেখাবার শিক্ষাটুকু না নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করতে এসে নিজ দেশের দশের মানহানি ঘটাতে তাদের বিবেকে বাধলো না। মানুষ এখন বৈশ্বিক হতে চলেছে, বিদেশীর হাতে বাংলা কবিতার বই দেখে বিস্মিত হয়েছি, নিজেও অন্য ভাষার টুকিটাকি শব্দ শেখার কৌতুহল নিয়ে মেতেছি। মানুষ যতটুকু সহজে মানবিক হতে পারে ঠিক তার চাইতে অমানবিকতার শিক্ষা নিতে চায় চট জলদি-এটা মনে হয় তার সহজাত প্রবৃত্তি, তাই বিদেশ বিভূঁই সর্বত্র অশালীন ভাষা আর ইঙ্গিত শিখতে সে প্রলুব্ধ হয় সহজে। আমার শিক্ষণীয় বিষয় হলো, নিজেকে এইটুকু জ্ঞান আহরন করাতে পারঙ্গম হলাম- যেখানেই যাই না কেন, যে কোন পরিবেশে অশালীন কিছু বলবো না – কে জানে আমার ভাষা তাদের কাছে মোটেও অবোধ্য নয়।

দিনের কেনাকাটা সমাপনান্তে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম ক্লান্ত হয়ে। রাতের সময়টুকু মালামাল বাঁধাই করে সামলে নিতে হবে, পরের দিন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে বার টায় বিমান বাংলাদেশ চড়ে ঢাকায় ফিরতে হবে। রাতের নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম সকল ক্লান্তি মুছে দিলো। সকাল ন’টায় যৎকিঞ্চিত নাশতা সেরে এয়ারপোর্ট রওয়ানা হলাম দু’জনে। আসগর ভাইয়ের হাতে তার স্পোর্টস কারের কাঁচের লম্বা উইন্ডো প্যান সামাল দিতে বেগ পাচ্ছিলেন, তবুও কষ্টের ফল মিষ্ট হয় মনে করে মেনে নিলেন। ইমিগ্রেশনের সকল প্রক্রিয়া শেষে আমরা প্লেনের ডান পাশের মধ্যবর্তী দু’খানা সিটে দখল নিলাম। বাইরের প্রচন্ড রোদের উত্তাপ ভিতরে এসে গায়ে লাগছিল। মনে হলো বিমানের শীততাপ সঠিক কাজ করছিল না, যাত্রীরা ঘেমে নেয়ে উঠলেন। সামনে কোন এক ঈদ-পর্ব ছিল, তাই মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দল ভারী দেখা গেল। বেশীর ভাগ যুবক আর নব্য ব্যবসায়ী, তাদের গায়ে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ আর পকেটে হঠাৎ জমে উঠা টাকার গরমে নিজেদের এক এক জন ‘ওনাসীস’ ভাবতে লাগলেন। প্লেন ছাড়তে বিলম্ব হচ্ছিল আর সবাই অধৈর্য হয়ে পড়লেন, চেঁচামেচিতে এক সময় মনে হলো আমরা নিউ মার্কেটের মাছ বাজারে আছি। হোটেল থেকে বেরোবার আগে ঢাকায় ফোন করে নিজ নিজ বাসায় জানিয়ে দিয়েছি এয়ারপোর্টে সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে গাড়ী পাঠিয়ে দিতে, দু’ঘন্টার ফ্লাইট তাই পৌছাবো ঢাকার সময় দিনের সাড়ে বারোটায়। এতো হৈ চৈ এর মাঝে নিশ্চুপ বসে বাকি যাত্রীদের সরস মন্তব্য উপভোগ করা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। হাত ঘড়িতে দেখলাম, স্থানীয় সময় দেড়টা বেজে গেছে কিন্তু প্লেন ছাড়ার কোন আলামত নেই। উত্তেজিত যাত্রীদের অশালীন মন্তব্যে বিমান বালা আর সঙ্গীয় পার্সার সম্ভবত ককপিটে আশ্রয় নিলেন, তাদের দেখা পাওয়া গেলো না। বেলা দু’টার সময় ক্যাপ্টেনের এনাউন্সমেন্ট শোনা গেল, -আমি ক্যাপ্টেন ম’………বলছি, আমাদের ফ্লাইট ছাড়তে বিলম্ব হওয়াতে আন্তরিক দুঃখিত। আমরা অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের বিমানের ফ্লাইট নম্বর ……যোগে ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিব। যাত্রীরা আশান্বিত হয়ে হাফ ছাড়লেন আর একটু পরেই প্লেন খানা দুলে উঠলে আমরা আল্লাহ্ র স্মরণ নিলাম। যাত্রীরা তাদের অশান্ত মনে শান্তির সুবাস পেয়ে নিশ্চুপ বসে রইলেন। প্লেন দ্রুত গতিতে দৌড়ে ঠিক উড্ডয়নের মুহূর্তে থমকে গেলো, যাত্রীরা ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলেন আর জোরে জোরে আল্লাহ্ র নাম নিতে লাগলেন। যাক! বাঁচা গেলো, কিছু হয়নি। প্লেন সেখানে অনেক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, আমরা উৎসুক দৃষ্টিতে বাহিরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে পানি চাইবো কার কাছে, কর্তৃপক্ষের কেউ নেই। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা আড়াইটার বেশী। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় কষ্ট পেয়ে যাত্রীরা ফুঁসে উঠলেন, আবার চেঁচামেচি শুরু হলো।

এক সময় বুঝা গেলো বিমান পিছন দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই আগের অবস্থানে। এবার অনেক যাত্রী বিমানের দরজায় আছড়ে পড়লেন যেন দরজা খুলে দেয়া হয় আর সবাই লাউঞ্জে গিয়ে বসতে পারেন আবার অনেকে তীব্র অনীহা প্রকাশ করলেন এই বিমানে চড়ে ঢাকা ফিরে যেতে। আমরা নীরব দর্শক হয়ে বসে রইলাম, মাঝে মধ্যে গলার স্বর উচিয়ে কিছু বলতে চাইলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের আওয়াজের তলানিতে পড়ে রইলো। নিজের ব্লাডারের উপর প্রচন্ড চাপ অনুভব করলাম কিন্তু অজানা কারণে টয়লেট ব্যবহারের অনুমতি নেই। জানিনা আমার মত আর যাদের সেই সমস্যা হয়েছিল তারা কি করে নিজেকে সামলে নিলেন। আসগর ভাই তার হাতে সেই বিশাল গ্লাস খন্ড ধরে ঠায় বসে আছেন, তিনি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে খুবই নাজুক মনে হলো। যাত্রীদের অনুরোধ রক্ষার জন্য থাই বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে ক্যাপ্টেইন যোগাযোগ করে জানালেন, প্লেন থেকে নামার অনুমতি মিলেনি কারণ যাত্রীদের ইমিগ্রেশন পর্ব শেষে বিমানে আরোহন করানো হয়ে গেছে, এখন নামতে দেয়া যাবে না। কি অমানবিক! অবস্থা, মনে হলো হাশরের ময়দানের ট্রায়াল দিচ্ছি, কেউ কারো কথা ভাবছি না, কারো দিকে তাকিয়ে দেখছি না, শুধু নিজেকে নিয়ে ‘ইয়া নফসী, ইয়া নফসী’ করছি। এরই মাঝে একজন যাত্রী সজোরে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলো, এ বিমান ঢাকা পৌঁছাবার আগেই নির্ঘাত ক্রাশ করবে। এবার বুঝুন মনের অবস্থা, একথা শোনার পর যাত্রীদের কেউ যেন হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন, বাকীরা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।

আমি অন্য কারো কথা সে মুহূর্তে ভাববার কথা নয়, নিজের কথা ভাবছিলাম, ঢাকায় বউ আর ছোট্ট দু’জন ছেলেমেয়ে- আমার কিছু হলে ওরা কি করে মেনে নিবে। গত কয়েক দিনের প্রতিটি কথা, অতীতের কথা মনের পর্দায় সাগরের ঢেউএর মত আছড়ে পড়তে লাগলো, আমি অবচেতন হয়ে পড়লাম। আসলে কি কারণে বিমান উড্ডয়নে বাধাগ্রস্থ এটুকু জানলেও মনে ভরসা পাওয়া যেত, কিন্তু সেটুকু জানার সুযোগ কারো নেই, এক উদ্ভট অবস্থা বিরাজ করছিল।

সময় জ্ঞান হারিয়ে এক সময় ঘড়ির দিকে তাকাবার কথা ভুলে গেলাম। এটুকু অনুভব করলাম, প্লেন আবার নড়ে উঠলো আর যাত্রীরাও নড়ে উঠলেন। আশা দানা বেঁধে উঠলো, এবার তবে যাত্রা শুরু হলো। প্লেন দ্রুত গতিতে দৌড়ে উড্ডয়নের ঠিক আগ মুহূর্তে একই অবস্থায় আটকে গেলো, এবার আরো বেশী লোকজন কান্নাকাটি করতে লাগলো। সেই সব তরুণ জোয়ান, যাদের উচ্ছ্বাস আর তারুণ্যের তড়পানি দেখে আগে বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম এখন তাদের নির্জীবতা দেখে অনুতপ্ত হলাম, হায় মানুষ! বিপদে সকল শক্তিমানরাও কাবু হয়ে যান আর বিপদ উত্তরণ হলে আবার আগের রূপে প্রকাশিত হোন। ক্ষুধা তৃষ্ণা আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়ে সবাই কাতর হয়ে মনে মনে আল্লাহ্র স্মরণ মাগতে থাকেন। কিন্তু কেন যেন তীব্র প্রতিবাদ কিংবা প্রতিকারের বিষয় নিয়ে কেউ আর তখন কিছু ভাবছিলেন না, সবাই নিজ নিজ স্রষ্টার আনুকূল্য পাওয়ার আশায় মগ্ন হয়ে রইলেন। তৃতীয় বার যখন একই অবস্থা দাঁড়ালো, তখন ঐ ব্যক্তির কথাই সঠিক মনে হলো – আমরা নিশ্চয় ঢাকা পৌঁছাতে পারছি না।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো, আরো একবার প্লেন নড়ে চড়ে উঠলেও যাত্রীদের মাঝে কোন উৎসাহ দেখা গেলো না। এবার প্লেন খানি ঠিকই দৌড়ে গিয়ে আকাশে উড়াল দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, স্থানীয় সময় রাত আট টার কিছু বেশি, ভাবনার রেশ হারিয়ে এখন আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করলো না, নিজের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কথাও কখন ভুলে গেছি মনে নেই হয়তো অন্যরাও ভুলে গেছেন, নয়তো………। অনেক যাত্রী ক্লান্তি আর অবসাদে নিদ্রায় ঢলে পড়েছেন, রাতের আঁধার পেরিয়ে আমাদের প্লেন উড়ে চলছে, আনন্দ বিষাদ কিছুই অনুভব করতে পারলাম না। আমার পাশে বসে আছেন আসগর ভাই অথচ তার অস্তিত্ব আমার কাছে গৌণ মনে হলো। এবার চমকপ্রদ এনাউন্সমেন্ট ভেসে এলো,… আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে রেঙ্গুন বিমান বন্দরে স্বল্প বিরতির জন্য অবতরণ করতে যাচ্ছি। ভিতর থেকে কোন কোন যাত্রীর উফ! আহ! ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া শোনা গেল না। আশেপাশে কারো একজনের অস্ফুট কথা কানে এলো, -দে বাবা, জঙ্গলে নামিয়ে দে, আর যে পারছি না।

রেঙ্গুন বিমান বন্দর, না চাহিলে যাহা পাওয়া যায়। কত স্বপ্ন দেখেছি নিষিদ্ধ দেশ বার্মা দেখা হলো না বলে, এবার না চাইতেই দেখা হবে, হোক না স্বল্পকালীন বিরতি। সকল প্যাসেঞ্জারকে সারিববদ্ধ হয়ে নামতে বলা হলো আর ডানে বামে না গিয়ে সোজা সেই পুরনো ধাঁচের একটি ঘরের দিকে তাড়িয়ে! নিয়ে চলল কিছু লুঙি পরা সেপাই- তাদের হাতে রয়েছে সেই মান্দাতার আমলের থি নট থ্রি রাইফেল। আমরা সবাই যখন সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম, কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখা গেলো দরজায় ই-য়া বড় এক তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এতো সব দেখে আসগর ভাই এর সরস মন্তব্য আজো কানে লেগে আছে, ‘ইন লোগ কিয়া সমঝতে হ্যায়, হাম লোগ ইহা রেহ জায়েঙ্গে’? দুঃখেরও এক প্রকার হাসি আছে, আমি প্রাণ খুলে হাসলাম।

এদিকে ঘরের ভিতর বাথরুম খুঁজে পেয়ে সবাই হামলে পড়লেন, অপ্রতুল ব্যবস্থা তবুও সবাই লাইনে দাঁড়ালেন আর নিষ্কৃতি পেলেন। এক ঘন্টার মত আমরা রেঙ্গুন বিমান বন্দরে আবদ্ধ রইলাম বাইরের কিছুই দেখা হলো না। এবার সেই সেপাইরা আগের মতো সারিবদ্ধ করে আমাদের বিমানে উঠিয়ে দিলো। মিনিট পাঁচেকের মুক্ত বাতাসে বন্দি জীবনের অবসান মুক্তির স্বাদ মিটিয়ে দিলেও আবার সেই অবস্থানে ফিরতে হলো। ভেবেছিলাম, রেঙ্গুনে কিছু খাবার পানীয় কিনে খেতে পারবো কিন্তু সেখানে কিছুই পাওয়া গেলো না। অগত্যা নিরুপায় হয়ে সবাই বসে রইলাম ঢাকায় ফিরার আশায়। ক্যাপ্টেন ম’…… ককপিটের বাইরে এসে মৌখিক ভাবে জানালেন, আমাদের বিমানে টয়লেটের পানি সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়াতে ওঅঞঅ রুলস অনুযায়ী ব্যাংকক কর্তৃপক্ষ বিমান উড্ডয়নে বাধ সাধেন কিন্তু শেষ অবধি তার সুরাহা না করেই এক সময় বিমানকে ফ্লাই করার অনুমতি দেন। পৃথিবীতে অনেক আশ্চর্য বিষয় জানার বাকি ছিল তাও জানা হয়ে গেলো।

বিমান উড়াল দিলো আর তখন বিমান বালা আর পার্সারের দেখা মিললো, ওরা এতক্ষন আত্মগোপনে ছিলেন। তাদের হাতে বিরিয়ানীর প্যাকেট আর একটি করে পানীয় বোতল সবাইকে বিতরণ করে সামনের দিক থেকে পিছনের আসন পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই এনাউন্সমেন্ট শোনা গেলো, যাত্রী মহোদয়গণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি…… আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা……বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি……। বিমান বাংলাদেশ……… আমাদের সাথে ভ্রমণ করার জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। খোদা হাফেয। এক চরম রসিকতার মত শোনালো। অনুভব করলাম বিমান ক্রমশ নীচের দিকে নেমে আসছে, যাত্রীদের হাতে তখন আধ খাওয়া বিরিয়ানির প্যাকেট আর পিছনের সারিতে কেউ বা সবে প্যাকেট হাতে পেয়েছেন। বিমানবালা তখন খাবারের প্যাকেট যাত্রীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে লাগলেন, একপ্রকার টানাটানি অবস্থা। পিছন থেকে কোন এক যাত্রীর তির্যক মন্তব্য কানে ভেসে এলো, আশি বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে এখন সন্তান কোলে তুলে নিতে চাইছেন, বেচারী বিমান বালার দিকে তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল।

ঢাকায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বিমান এসে ঢাকায় নামলো, আমরা প্রতিটি যাত্রী শারীরিক মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজেকে টেনে নিয়ে বিমান বন্দর থেকে এক অনিশ্চয়তার দিকে বেরিয়ে এলাম। বাসায় যাওয়ার উপায় কি হবে? সঙ্গে অনেক দামী মালামাল মানে গাড়ীর প্রয়োজনীয় পার্টস যেগুলি ছাড়া কাস্টমারের গাড়ি ডেলিভারি দেয়া আটকে আছে। আমাদের এমন কষ্টের কথা জেনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হয়তো দয়াপরবশ হয়ে নির্বিঘেœ বেরিয়ে যেতে দিলেন। বাইরে এসে দেখি আমাদের উভয়ের ড্রাইভার অপেক্ষমান এবং দিনভর আর সন্ধ্যা নাগাদ কয়েকবার বাসা আর বিমান বন্দর ছুটাছুটি করে অবশেষে জানতে পেরেছেন আমরা রাত দশটা নাগাদ ঢাকা এসে পৌঁছাবো। বাসায় বউ ছেলেমেয়ে চিন্তায় আধখানা হয়ে রয়েছেন। আসগর ভাইএর কাছে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে ছুটে চললাম। বিমান বন্দর থেকে বাসায় ফেরার পথে ভাবছিলাম, আমরা না হয় বসে বসেই অবসাদগ্রস্থ হয়েছি কিন্তু বেচারা ক্যাপ্টেন ম’……, তার কো পাইলট আর ত্রু বাহিনীকে না জানি কত কষ্ট পোহাতে হয়েছে। এতগুলি যাত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে আমাদের এক দুর্বিষহ যাত্রায় আকাশ পাড়ি দিয়ে নিয়ে এলেন।

লেখক: অটোমোবাইল প্রকৌশলী।