শিক্ষকতায় বর্গা প্রথা: অবসানে স্থানীয় সরকারের পদক্ষেপ জরুরী ।।

0
915

শিক্ষকতায় বর্গা প্রথা: অবসানে স্থানীয় সরকারের পদক্ষেপ জরুরী
পপেন ত্রিপুরা

শিক্ষকতায় বর্গা পদ্ধতি? হ্যাঁ, ঠিক তাই। ধরুন, একটি বিদ্যালয়ে আমিসহ আমরা তিন-চারজন সরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক, আমরা কেউই স্কুলে যাই না। আপনি আমাদের পরিবর্তে পাঠদান করান। আমরা আপনাকে প্রতিমাসে লামসাম কিছু দিই। আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা ফাইভ পাশ বা এইট পাশ বা সর্বোচ্চ মেট্রিক পাশ। আপনাকে সামলাতে হবে ছয় ছয়টা ক্লাশ। আর এই অনৈতিক ও বেআইনি প্রথা-পদ্ধতি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে চলছে। এবং সবার গোচরে চলছে।

ভোটের রাজনীতিতে আমাদের পলিটিশিয়ানরা উন্নয়নম‚লক কর্মস‚চির পাশাপাশি বিপরীত কর্মস‚চিও বাস্তবায়ন করে থাকেন। যেমন- মন্দির নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, ক্লাব ইত্যাদি। এতে মানুষের কিছু মানসিক চাহিদা আর টেন্ডারবাজদের পকেট পূরণ পূর্ণতা পায় মাত্র। কিন্তু এমন কিছু কর্মসূচি রয়েছে যেটা বাস্তবায়ন করলে লক্ষ-কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা হবে এবং এই রাষ্ট্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে একজন শিক্ষকের পক্ষে পাঠদান করা সম্ভব নয়। আবার সেখানে অবস্থান করে পাঠদান করার জন্য একজন শিক্ষকের জন্য কিছু সুবিধাদি প্রয়োজন রয়েছে সেটা এলাকাবাসীর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না এবং সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

এরকম বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক আবাসন অত্যাবশ্যক জরুরী। একজন শিক্ষকের জন্য দরকার একটা বাসযোগ্য ঘর। যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত জল, আলো, বাতাসসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। শহরের কাছাকাছি এলাকায় আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত নামে-বেনামে কত ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় অবহেলায় পড়ে আছে। জেলা পরিষদের বাস্তবায়িত কত ভবন অবহেলায় পড়ে থাকে। কত এনজিও সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত ওয়াশ বøক, টয়লেট রাস্তার ধারে ধারে দেখা যায়, যা কখনো ব্যবহার করতে দেখা যায় না। অথচ আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো এখনো টিনের বেড়ায় নির্মিত। দরজা-জানালা থাকে ভাঙ্গা। স্কুলের কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য কোনো আলমারি নেই। নেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চ।

সরকার একটা মহৎ উদ্যোগ নিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবাসিক চালু করবে। যাতে দূর ক্যাচমেন্টের শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে পারে। এই স্কুল আবাসিক চালু হলে সরকার নিশ্চয় আবাসিক শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এই ঘোষণা কবে সম্প‚র্ণ বাস্তবায়ন হবে তার কোনো রোডম্যাপ নেই। তাই স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করতে চাই, আপনাদের সুদৃষ্টি যেন প্রথমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়ের দিকে থাকে। আমাদের স্থানীয় সরকার চায়লে জাতীয়ভাবে বাস্তবায়নের অপেক্ষা না করেও এ কাজে হাত দিতে পারে। কত মন্দির-মসজিদ নির্মাণে আমরা কোটি টাকা ব্যয় করছি, শিক্ষা উন্নয়নে, শিশুদের শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা কি পারি না তিন পার্বত্য জেলায় বেছে বেছে আপাতত অন্তত ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫টি শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করতে? ১৫টি শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করে দিতে পারলে একটা অভিশাপ বর্গা শিক্ষকতা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। শিক্ষকতায় বর্গা পদ্ধতি? হ্যাঁ, ঠিক তাই। ধরুন, একটি বিদ্যালয়ে আমিসহ আমরা তিন-চারজন সরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক, আমরা কেউই স্কুলে যাই না। আপনি আমাদের পরিবর্তে পাঠদান করান। আমরা আপনাকে প্রতিমাসে লামসাম কিছু দিই। আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা ফাইভ পাশ বা এইট পাশ বা সর্বোচ্চ মেট্রিক পাশ। আপনাকে সামলাতে হবে ছয় ছয়টা ক্লাশ। আর এই অনৈতিক ও বেআইনি প্রথা-পদ্ধতি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে চলছে। এবং সবার গোচরে চলছে।থাক, এসব ঝামেলা নিয়ে লিখে বিপদে পড়ার দরকার নেই। বরং অন্য প্রসঙ্গ টানি….।

ভোটের রাজনীতিতে আমাদের পলিটিশিয়ানরা উন্নয়নম‚লক কর্মস‚চির পাশাপাশি বিপরীত কর্মস‚চিও বাস্তবায়ন করে থাকেন। যেমন- মন্দিও নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, ক্লাব ইত্যাদি। এতে মানুষের কিছু মানসিক চাহিদা আর টেন্ডারবাজদের পকেট পূরণ পূর্ণতা পায় মাত্র। কিন্তু এমন কিছু কর্মসূচি রয়েছে যেটা বাস্তবায়ন করলে লক্ষ-কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা হবে এবং এই রাষ্ট্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে একজন শিক্ষকের পক্ষে পাঠদান করা সম্ভব নয়। আবার সেখানে অবস্থান করে পাঠদান করার জন্য একজন শিক্ষকের জন্য কিছু সুবিধাদি প্রয়োজন রয়েছে সেটা এলাকাবাসীর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না এবং সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। এরকম বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক আবাসন অত্যাবশ্যক জরুরী। একজন শিক্ষকের জন্য দরকার একটা বাসযোগ্য ঘর। যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত জল, আলো, বাতাসসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। শহরের কাছাকাছি এলাকায় আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত নামে-বেনামে কত ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় অবহেলায় পড়ে আছে। জেলা পরিষদের বাস্তবায়িত কত ভবন অবহেলায় পড়ে থাকে। কত এনজিও সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত ওয়াশ বøক, টয়লেট রাস্তার ধারে ধারে দেখা যায়, যা কখনো ব্যবহার করতে দেখা যায় না। অথচ আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো এখনো টিনের বেড়ায় নির্মিত। দরজা-জানালা থাকে ভাঙ্গা। স্কুলের কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য কোনো আলমারি নেই। নেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চ।

সরকার একটা মহৎ উদ্যোগ নিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবাসিক চালু করবে। যাতে দূর ক্যাচমেন্টের শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে পারে। এই স্কুল আবাসিক চালু হলে সরকার নিশ্চয় আবাসিক শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এই ঘোষণা কবে সম্প‚র্ণ বাস্তবায়ন হবে তার কোনো রোডম্যাপ নেই। তাই স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করতে চাই, আপনাদের সুদৃষ্টি যেন প্রথমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়ের দিকে থাকে। আমাদের স্থানীয় সরকার চায়লে জাতীয়ভাবে বাস্তবায়নের অপেক্ষা না করেও এ কাজে হাত দিতে পারে। কত মন্দির-মসজিদ নির্মাণে আমরা কোটি টাকা ব্যয় করছি, শিক্ষা উন্নয়নে, শিশুদের শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা কি পারি না তিন পার্বত্য জেলায় বেছে বেছে আপাতত অন্তত ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫টি শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করতে? ১৫টি শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করে দিতে পারলে একটা অভিশাপ বর্গা শিক্ষকতা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের নিকট একটা আকুতি জানাতে চাই। জাতীয়ভাবে ঘোষণার অপেক্ষা না করে, বিশেষ পরিবেশের কথা বিবেচনা করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক আবাসন নির্মাণসহ বেশ কিছু জরুরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। চলতি আলোচনায় দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসা প্রচলিত একটা সমস্যা উপস্থাপন করবো। যে সমস্যাটিকে অনৈতিক এবং বেআইনিভাবে জিইয়ে রাখা হয়েছে যুগের পর যুগ। আর সেটা হলো, শিক্ষকতায় বর্গা প্রথা। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক স্কুলে না গিয়ে সেখানকার পঞ্চম শ্রেণি পাশ বা আন্ডার মেট্রিক লোক দিয়ে স্কুলে পাঠদান করানো হয়। বিনিময়ে সেই বর্গা শিক্ষক পায় মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন এবং অষ্টম শ্রেণি পাশ বা নন-মেট্রিক লোক দিয়ে চলছে শিক্ষার ভিত প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম। বিষয়টি সবার অগোচরে রয়েছে এমনটাও নয়। উপেজলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে অবগত রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক পরিবেশ নাজুকতার কারণে নানান ধরণের সমস্যা থাকতেই পারে। তাই বলে এটাকে সমাধান না করে যুগের পর যুগ জিইয়ে রাখা কি মানবতার কাজ? এটা কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় আচরণ? এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে রাষ্ট্রের ঘোষিত লক্ষ্য দেশে শতভাগ শিক্ষার হার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? নাকি যে সমস্ত অঞ্চলে, যে সমস্ত বিদ্যালয়ে এ প্রথা চলছে, সেই সব অঞ্চল-বিদ্যালয় বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত বলে ধরে নেয়া হবে? যদি তাও হয়, তাহলেও জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলো, বাতাস, জল লভ্যতাসহ বিদ্যালয়ের পাশে শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করে দিলে আমাদের শিক্ষকগণ নিশ্চয় তাদের নিয়মিত পাঠদান চালাবেন। রাঙামাটি জেলা সদরের বাসিন্দা একজন নারী শিক্ষককে সাজেকের সেই শিয়ালদাইলুই স্কুলে দায়িত্ব দিলে সেই শিক্ষকের পক্ষে সেখানে গিয়ে দায়িত্ব পালন করা আদৌ সম্ভব না। তার মধ্যে যদি সেই শিক্ষক হন বাঙালি, তাহলে তো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু এটাই বাস্তব। এবং একজন বাঙালি নারী শিক্ষককে সাজেকের একটি স্কুলে নিয়োগ করা হয়েছে।

সাজেকের রুইলুই থেকে শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম পায়ে হাঁটা পথ। এবং এক থেকে দুইদিন সময় লাগে। এই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে আছেন, রাঙামাটি সদরের বাসিন্দা সান্তা নামে একজন নারী শিক্ষক। স্কুল, স্কুলের বাচ্চারা, বর্গা শিক্ষকদ্বয়, অভিভাবক কেউই এই নারী শিক্ষক সান্তা ম্যাডামকে দেখেনি কখনো। এই দায় কি সান্তা ম্যাডামের? তিনি সর্বোচ্চ বাঘাইছড়ি বা বাঘাই হাটে গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারবেন, এটা আশা করা যায়। সেখান থেকে যানবাহনে সর্বোচ্চ রুইলুই পর্যন্ত যাওয়া যায়। রুইলুই থেকে কর্মস্থলে পৌঁছতে তাকে পায়ে হাঁটতে হবে। স্কুলে পৌঁছতে তার সময় লাগবে দুইদিন। একজন বাঙালি নারী জঙ্গলের ভিতর গিয়ে অবস্থান করে স্কুলে পাঠদান করা কখনো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। সুযোগও নেই। যদি সেখানে শিক্ষক আবাসন থাকতো, আবাসনে আলো, বাতাস, জলের ব্যবস্থা থাকতো তবুও সান্তা ম্যাডামের পক্ষে শিয়ালদাইলুইয়ে অবস্থান করা সম্ভব না। প্রশ্ন হলো, কোন্ বিবেচনায় তাঁকে সেখানে বদলী করা হয়েছিল? তিনি একজন ক্ষমতাসীন দলের নেতার স্ত্রী বলে? স্কুলে না গেলেও কেউ আঙ্গুল তোলার সাহস থাকবে না এই ভেবে? আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি, এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রশাসনের উচিত সেখানে একজন কর্মঠ, কম বয়সী এবং স্থানীয়দের স্বগোত্রের একজন পুরুষকে দায়িত্ব দেয়া। আমি মনে করি, ইচ্ছা শক্তি থাকলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে ভালবেসে থাকলে একজন পুরুষ শিক্ষকের পক্ষে সেখানে অবস্থান করে পাঠদান করা অবশ্যই সম্ভব।

আপনি যদি সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে থাকেন, আপনি যদি সত্যিই ‘মানুষ গড়ার কারিগড় হয়ে থাকেন। আপনার পক্ষে অবশ্যই সম্ভব, আপনি যদি ‘শিক্ষকের মর্যাদা’, ‘শিক্ষকের গুণাবলী’, ‘শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য’, শিক্ষকের আদর্শ’ এই জাতীয় প্রবন্ধ রচনা, অনুচ্ছেদ পড়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে পাস করা ছাত্র হয়ে থাকেন, আপনার পক্ষে অবশ্যই সম্ভব। আপনি যদি আপনার ছেলে-মেয়েকে পড়াশুনা করিয়ে মানুষ করার ব্রত নিয়ে থাকেন তাহলে আরেকজনের ছেলে-মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে পারেন না। আপনার যদি বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ থেকে থাকে তাহলে বাড়িতে বসে বসে সরকারি বেতন খেয়ে সহজ-সরল পাহাড়ি মানুষের নিষ্পাপ শিশুদের সাথে প্রতারণা করতে পারেন না। যদি করেই থাকেন তাহলে আপনি নিজেই নিজেকে বিবেচনা করুন যে, আপনি কি মানুষ নাকি অন্য কিছু…। এক্ষেত্রে আপনি হাজারো যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন। হয়তো বলবেন, স্কুল অনেক দ‚রে, পায়ে হেঁটে যেতে হয়, হেঁটে যাওয়া ঝুঁকি ইত্যাদি..। আরে মশাই, সরকার আপনাকে পরিশ্রম করানোর জন্যই নিয়োগ দিয়েছে, বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য নয়। আপনার ভাগ্যই আপনাকে একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু দেখুন, আপনি যাচ্ছেনই না। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, এই প্রজাতন্ত্রের সত্যিকারের মালিক হলো সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষেররাই আপনাকে বেতন দেয়। সাধারণ জনগণের দেয়া বেতনের টাকায় আপনি আপনার ছেলেমেয়েকে ভাল ভাল স্কুলে পড়াচ্ছেন, ভাল ভাল পরাচ্ছেন, ভাল ভাল খাওয়াচ্ছেন। শিক্ষক সমাজকে সম্মান রেখেই বলছি, আপনারা সবাই ‘শিক্ষক’ হতে পারেননি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন কেবল সরকারি চাকরিজীবি হিসেবে। আপনাদের এই চাকরিজীবি শিক্ষকরা শত শত শিশুদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তাদেরকে পড়ানোর জন্য দায়িত্ব নিয়ে পালন করেনি, এখনো করছে না। কিন্তু কেন? আমরা এই রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে এই জবাবদিহিতা অন্তত চাইতে পারি। যদি জবাবদিহিতা নাও দেন তাহলে আপনাকে অনুরোধ করতে চাই, সরকারের অর্পিত দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।

এক্ষেত্রে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উচিত হবে, স্থানীয়দের মধ্য থেকে ন‚ন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা যাদের আছে, তাদেরকেই সেখানে নিয়মিত এবং সরকারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। এক্ষেত্রে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মন্ত্রণালয় তো আগে থেকেই আইন করে বসে আছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন পুরুষকে সহকারী শিক্ষক হতে হলে তাকে অবশ্যই ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী হবে এবং নারীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট ডিগ্রিধারী। কিন্তু যারা বর্তমানে সাজেকের বিভিন্ন স্কুলে বর্গা শিক্ষক হিসেবে আছেন, তাদের মধ্যে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী এখনো তৈরী হয় নাই। সর্বোচ্চ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, মাধ্যমিক পাশ রয়েছে। ফাইভ পাশ, এইট পাশদের কথা বাদ দিয়ে হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় অন্তত মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বর্গা শিক্ষকদের নিয়মিত সরকারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় না? আমি জানি না। প্রবিধানের মাধ্যমে, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কি উদ্যোগ নেয়া যায় না? সাজেকের দুই-চারজন যারা সাজেক থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষিত হচ্ছে, মাধ্যমিক পাশ করেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে তাদেরকেই আবার সেই সাজেকের অচল স্কুলগুলো পরিচালনা করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে হবে। অন্তত, যতদিন সাজেকে শিক্ষিতের হার মোটামুটি পাঁচটা আঙ্গুল গোনা যাবে না ততদিন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নয়, ইন্টারভিউ নয় সেখানে যে ক’জন মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা লোক পাওয়া যাবে তাদেরকেই সেখানে নিয়োগ দিতে হবে। সময় বিবেচনা করে জারি করা বিশেষ প্রজ্ঞাপন, প্রবিধান প্রত্যাহার করা যেতে পারে। অথবা সাজেকের প্রতিটি স্কুলে শিক্ষক আবাসনের সুব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে থাকতে হবে, পর্যাপ্ত আলো, পানি, বাতাস ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থা করে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আবাসিকে থেকে পাঠদানে বাধ্য করাতে হবে শিক্ষকদের। সাজেকের স্কুলগুলোতে নারী শিক্ষক বদলী করা, নিয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে যতজন রয়েছে তাদেরকেও অন্যত্র বদলীর ব্যবস্থা করে সেস্থলে একজন কম বয়সী, স্থানীয়দের স্বগোত্রীয় পুরুষ নিয়োগ করতে হবে। তাহলেই কিছুটা হলেও সাজেকের শিকশুরা শিক্ষার আলো পেতে পারে।

আমাদের সাধারণ জ্ঞান যতটুকু জানি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত চাকরিজীবি ব্যক্তিকে সরকার দেশের যে কোনো জেলার যে কোনো প্রান্তে দায়িত্ব দিলে ব্যক্তি সেখানে গিয়ে কর্তব্য পালন করা প্রজাতন্ত্রের নিয়ম। একজন জেলা প্রশাসক দেশের যে কোনো জেলায় গিয়ে দায়িত্ব পালনে বাধ্য। ঢাকায় বসে কোনো জেলা প্রশাসক খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসন তত্ত¡াবধান করেছেন, এমন নজির আমার জানা নেই। কিন্তু একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যালয়ে পাঠদান না করে বছরের পর বছর বাড়িতে বসে সরকারি বেতন খেতে পারেন, খেয়ে চলেছেন এমন নজির অগুণিত। অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা এ ধরণের নজির দিতে পারি।
একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল তত্ত¡াবধান করে থাকেন একজন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাসহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন। দাফতরিক কাজ ছাড়াও শিক্ষা অফিসের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করা। বিদ্যালয় ঠিকমতো চলে কি না, শিক্ষকরা ঠিকমতো বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পাঠদান করেন কি না ইত্যাদি তদারকি করা। কিন্তু বাস্তবে কি এরকমটা হয়েছে? অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামে এরকমটার শতভাগ হয় না বলে আমার ধারণা এবং প্রমাণিত। একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ৫০ থেকে ৬০ বছর যাবত্ কোনো শিক্ষক পাঠদান করেন না, এমন কয়েকটি স্কুলের তথ্য উপস্থাপন করবো চলতি আলোচনায়।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে এরকম একাধিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দেখা যায়, শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৯৬২) বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৯৬৩) ও তুইচুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৯৬৫)। প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এই তিনটি বিদ্যালয়ে সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারা কখনোই পাঠদান হয়নি। এখনো হয় না। সেসব স্কুলে বদলী হওয়া শিক্ষকরা যোগদান করার পর প্রথম একবার গিয়ে পরিদর্শন করে আসেন। এই পরিদর্শনে তারা ম্যানেজিং কমিটি আর বর্গা শিক্ষকদের সাথে কথা বলে সবকিছু পাকাপোক্ত করে আসেন। তাদের পূর্বে যে শিক্ষকরা বর্গা শিক্ষকদের যা দিতেন তারাও অনুরূপ দিয়ে থাকেন, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। কোনো কোনো শিক্ষক একবারের জন্যও বিদ্যালয় পরিদর্শন করেনি বলে জানা গেছে। বিদ্যালয়ের দরজা-জানালা কয়টা, কয়টা কক্ষ এবং স্কুল ভবনটি পাকা নাকি কাঁচা তাও বলতে পারেন না। প্রতিবার নতুন বছরে নতুন পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রিও বর্গা শিক্ষকরাই নিয়ে যান স্কুলে। সরকারি শিক্ষকরা কেবল শিক্ষা অফিস থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। বিদ্যালয় মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয় করার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প দিলেও সাজেকের এই স্কুলগুলোতে নথিপত্র সংরক্ষণ করার মত কোনো আলমারি নেই বলে জানা যায়। বর্গা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থী হাজিরা খাতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র সংরক্ষণ করেন তাদের বাড়িতে।

শিক্ষক হাজিরা খাতা থাকে স্কুলে না যাওয়া শিক্ষকদের হাতে। বিদ্যালয়ের মাসিক – ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বছরের শুরুতে একবারই সব ক’টা তৈরি করে তাতে অগ্রিম স্বাক্ষর নেয়া হয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির। এই তিনটি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিরা থাকেন স্কুল ক্যাচমেন্টের বাইরে। এমনকি সাজেক ও জেলার বাইরেও অবস্থান করছেন দীর্ঘ বছর ধরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনজনের মধ্যে একজন থাকেন রুইলুই পর্যটন এলাকায়, আরেকজন থাকেন বাঘাইছড়ি সদরে এবং তৃতীয়জন থাকেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায়। তিনজনের দুই সভাপতি একাধারে একটি মৌজারও প্রধান (হেডম্যান)।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের সাথে শিক্ষকদের রফাদফা হয় বলেও স্থানীয় সচেতনজনরা অভিযোগ করেছেন একাধিকবার। রফাদফার অভিযোগ না থাকলেও বিচার করলে বিষয়টি জলের মতোই স্বচ্ছ হবে। যদি জানতে চাওয়া হয়, স্কুল কীভাবে চলছে, তাহলে কোনো সভাপতিই সঠিক তথ্য দিতে পারবেন না। শিক্ষকরা স্কুলে যান না, এ বিষয়টি সভাপতিরাই বেশি ভাল করে জানেন। তবুও কেন তারা স্কুল ও স্কুলের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেননি। আবার কোনো কোনো সভাপতি এর আগে অলিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাননি বলে জানা যায়। উল্টো তাদেরকে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। জানা যায়, শিক্ষকরা প্রায় সময় অদৃশ্য শক্তি ভাড়া করে থাকেন। ম‚লত এই কারণেই স্কুলের সচেতন অভিভাবকরা নিরবে মেনে নিয়েছেন।

ম‚ল সমস্যা হলো, যে স্কুলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেইসব স্কুলগুলো অনেক দ‚রে পাহাড়ের গহীন অরণ্যে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে কোনো শিক্ষকের পক্ষে স্কুল চালানো সম্ভব নয়! যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। কোনো রাস্তাঘাট নেই। সুতরাং পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছা কারোর পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু সেখানেও মানুষই বসবাস করছে। সহস-সরল মানুষেরা সেখানে শতাব্দিকাল ধরে অবস্থান করছে। সেখানে মানুষ ছিল বলেই ১৯৬১ সাল থেকে সেখানে স্কুল স্থাপিত হয়েছে। তাহলে এই শিক্ষকরা কোন জাতের মানুষ, জানতে ইচ্ছা জাগে।

যাই হোক, এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে সমস্যা আরো বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ এ সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই কম-বেশি জড়িত। শিক্ষা ডিপার্টমেন্ট, জেলা পরিষদ, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক, অদৃশ্য শক্তি সবাই জড়িত। মনে হচ্ছে, সাজেকের সহজ-সরল ত্রিপুরা শিশুদের শিক্ষা অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য সবাই জোট বেঁধেছে। সমাধানে যেতে চাইলে আমাদেরকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয় বর্গা শিক্ষকদের সরকারিভাবে নিয়োগ করা, নয় সেখানে শিক্ষক আবাসন নির্মাণ করে সকল ধরণের সুবিধা দিয়ে শিক্ষকদের তাদের স্ব স্ব স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া। সিদ্ধান্তের মালিক রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এ সমস্যা শুধু সাজেকে নয়, রাঙামাটির অন্যান্য উপজেলা ও আরো দুই পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এ সমস্যা কঠিন রোগের মতো আক্রান্ত হয়ে আছে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এরকম বেশ কয়েকটা স্কুল রয়েছে বলে শোনা যায়। যথা- মেরুং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বিষ্ণু কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বোয়ালখালী ইউনিয়নের বব্রæুবাহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এই যে সাজেক ও দীঘিনালার সমস্যার কথা বলছি, যেখানে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ৫৪ বছর যাবত্ সরকারিভাবে নিয়োগকৃত কোনো শিক্ষক দ্বারা পাঠদান হচ্ছে না। শুধু সাজেক বা দীঘিনালা নয়। একটা নয়, দুইটা নয়। এরকম অসংখ্য স্কুল খুঁজে পাবেন এই পাহাড়ে। স্কুলের ভবন আছে, পড়ার জন্য কচি কচি শিশু শিক্ষার্থী আছে, পাহাড়ের পাহাড়ি শিশু। সেসব স্কুলে পাঠদান করানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা আছে, শিক্ষকদের মাসে মাসে বেতন দেয়া হচ্ছে, স্কুল পরিচালনার জন্য কমিটি আছে। কিন্তু সেসব সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষক দ্বারা কখনো পাঠদান হয় না। সেসব স্কুলে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় না, গাওয়া হয় না ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীত। স্কুল আছে, শিক্ষার্থী আছে, বেতনভুক্ত শিক্ষক আছে, পাঠদান নেই।

আপনার কি একটিবারের জন্যও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না? যে, সাধারণ জনগণের দেয়া বেতন খেয়ে শিক্ষকরা তাহলে কেন পাঠদান করেন না? স্কুলে না গিয়ে কীভাবে বছরের পর বছর বাড়িতে বসে বেতন হজম করেছেন, করছেন? স্কুল-শিক্ষকদের তত্ত¡াবধান করার জন্য সেখানে কোনো শিক্ষা অফিস, শিক্ষা কর্মকর্তা নেই? যদি থাকে তাহলে কি তারা খুব ক্ষমতাশালী শিক্ষক? কীভাবে সম্ভব? সেখানে কী উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কেউ নেই? আমিতো অবাক হই যে, এত দুঃসাহস হয় কী করে এসব শিক্ষকদের? আরেকটা প্রশ্ন করতে পারেন, অভিভাবক বা ম্যানেজিং কমিটির লোকজন কি কোনোদিন কোথাও অভিযোগ করেনি?

আমি যতদ‚র জানি, অভিযোগ সেভাবে করা হয়নি। তবে অনুযোগ রয়েছে। কারণ অভিযোগ করার জন্য শক্তি সামর্থ, সাহস, বুদ্ধি-জ্ঞান থাকতে হয়। যেসব স্কুলে এই শিক্ষা সন্ত্রাস চলছে, সেসব স্কুল ক্যাচমেন্টের অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটির লোকজনের অভিযোগ করার মতো কোনো শক্তি সামর্থ, সাহস, জ্ঞান-বুদ্ধি কোনোটাই নেই। অতীতে বেশ কয়েকবার অভিযোগ করা হয়েছিলও। কিন্তু যারা অভিযোগ করেছিল, তারা কোনো না কোনোভাবে, কারো না কারো দ্বারা চাপ প্রয়োগের শিকার হয়েছিল, নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিল। ওইসব শিক্ষকরা প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী এবং অতি ভয়ংকর।
একটা প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ’। ঠিক সেরূপ যিনি বা যারা সেইসব স্কুলে বদলী হন তারাও পূর্বের শিক্ষকদের মতো বাড়িতে বসে বসে রাষ্ট্রের কোষাগার ক্ষয় করতে থাকেন। অনেক শিক্ষক আছেন, যারা এখনো তাদের কর্মস্থল স্কুলটিও দেখেননি। এমনও তথ্য আছে, একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার কর্মস্থল স্কুলে যোগদান করার দুই বছরেও সেই স্কুলে তার পায়ের ধ‚লো পড়েনি। কিন্তু হেড মাস্টার মশাই মাসে মাসে মাইনে তুলে খাচ্ছেন ঠিকই। কি, আশ্চর্য লাগছে? কোনো ব্যাপার না, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্কুলে কোনো শিক্ষকের পদার্পন হয়নি। এমন নয় যে, সরকার সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়নি।

সেই ১৯৬০-৬৫ সালে স্কুলে স্থাপিত কিন্তু এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। সরকার স্কুলের ভবন দিয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে, শিক্ষকদের মাসে মাসে বেতন দিয়ে যাচ্ছে সরকার। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাজেক ইউনিয়নের কয়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরবো এই আলোচনায়। যেসব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক(শিশু শ্রেণি) ও প্রথম শ্রেণি আলাদা করে চালু নেই। পড়ানো হয় না জাতীয় পাঠ্যপুস্তক। উভয় শ্রেণির শিশুদের দুই বছর বাল্যশিক্ষা পড়ানো হয়। তারপর সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়। একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার কর্মস্থল স্কুলে যোগদান করার দুই বছরেও সেই স্কুলে তার পায়ের ধ‚লো পড়েনি। কিন্তু হেড মাস্টার মশাই মাসে মাসে মাইনে তুলে খাচ্ছেন ঠিকই। কি, আশ্চর্য লাগছে? কোনো ব্যাপার না, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্কুলে কোনো শিক্ষকের পদার্পন হয়নি। এমন নয় যে, সরকার সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়নি। সেই ১৯৬০-৬৫ সালে স্কুলে স্থাপিত কিন্তু এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। সরকার স্কুলের ভবন দিয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে, শিক্ষকদের মাসে মাসে বেতন দিয়ে যাচ্ছে সরকার।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাজেক ইউনিয়নের কয়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরবো এই আলোচনায়। যেসব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক(শিশু শ্রেণি) ও প্রথম শ্রেণি আলাদা করে চালু নেই। পড়ানো হয় না জাতীয় পাঠ্যপুস্তক। উভয় শ্রেণির শিশুদের দুই বছর বাল্যশিক্ষা পড়ানো হয়। তারপর সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়।

আলোচনা-০১: বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬৩ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে নিয়োগকৃত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক রূপক চাকমা, সহকারী শিক্ষক ফুল কুমারী চাকমা ও সুমিতা চাকমা। কিন্তু স্কুল ও শিক্ষকদের মধ্যে কখনো পরিচয় ঘটেনি। এই তিনজন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন বর্গা শিক্ষক হরেন বিকাশ ত্রিপুরা। তাকে প্রতি মাসে দেয়া হয় ৬,০০০ টাকা। তিনি এই স্কুলের একাধারে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক সবকিছু। এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি রথাল পাংখোয়া থাকেন রুইলুই পর্যটন এলাকায়। বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯৩জন। শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক তালিকা নিম্নরূপ-

নং শ্রেণী বালক বালিকা মোট
০১ শিশু শ্রেণী বাল্য  শিক্ষা ১১ ১৩ ২৪
০২ ১ম শ্রেণী ১১ ১৩ ২৪
০৩ ২য় শ্রেণী ১০
০৪ ৩য় শ্রেণী ১০ ১৯
০৫ ৪র্থ শ্রেণী ১০
০৬ ৫ম শ্রেণী

 

আলোচনা-০২: শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত চাকমা, সহকারী শিক্ষক বশিউর রহমান ও সান্তা …..(?)। সহকারী শিক্ষক সান্তা ম্যাডামের টাইটেল বর্গা শিক্ষক বা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। বর্তমানে বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন, ধনেশ্বর ত্রিপুরা ও সোনালী ত্রিপুরা। তাদের জনপ্রতি বাৎসরিক বেতন ৩০ হাজার টাকা করে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হেডম্যান যৌপৈথাং ত্রিপুরা থাকেন বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে। এ বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫৫ জন। শেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছিল দুইজন। একজন বালক ও একজন বালিকা।

শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক ছাত্রছাত্রীর তালিকা নিম্নরূপ-

আলোচনা-০২: শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত চাকমা, সহকারী শিক্ষক বশিউর রহমান ও সান্তা …..(?)। সহকারী শিক্ষক সান্তা ম্যাডামের টাইটেল বর্গা শিক্ষক বা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। বর্তমানে বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন, ধনেশ্বর ত্রিপুরা ও সোনালী ত্রিপুরা। তাদের জনপ্রতি বাৎসরিক বেতন ৩০ হাজার টাকা করে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হেডম্যান যৌপৈথাং ত্রিপুরা থাকেন বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে। এ বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫৫ জন। শেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছিল দুইজন। একজন বালক ও একজন বালিকা।
শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক ছাত্রছাত্রীর তালিকা নিম্নরূপ-

নং শ্রেণী বালক বালিকা মোট
০১ শিশু শ্রেণী বাল্য  শিক্ষা ১৩ ১০ ২৩
০২ ১ম শ্রেণী ২৪
০৩ ২য় শ্রেণী
০৪ ৩য় শ্রেণী
০৫ ৪র্থ শ্রেণী
০৬ ৫ম শ্রেণী

 

আলোচনা-০৩: তুইচুই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
তুইচুই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬৫ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে নিয়োজিত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক সুজিত দত্ত, সহকারী শিক্ষক সমর্পন চাকমা ও অজ্ঞাত (নারী শিক্ষক)। বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন, রহিত ত্রিপুরা ও জীবন ত্রিপুরা। বর্গা শিক্ষকদ্বয় মাসিক বেতন পান ৪,৫০০ টাকা। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হেডম্যান গরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার স্থায়ী বাড়ি খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের নয়মাইল এলাকায়। বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪৭ জন। শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক ছাত্রছাত্রীর তালিকা নিম্নরূপ-

নং শ্রেণী বালক বালিকা মোট
০১ শিশু শ্রেণী বাল্য  শিক্ষা ১২ ১২ ২৪
০২ ১ম শ্রেণী
০৩ ২য় শ্রেণী ১২
০৪ ৩য় শ্রেণী
০৫ ৪র্থ শ্রেণী

গত পঞ্চম শ্রেণিতে ছিল চারজন। গত সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছিল ৩ জন। চারজন থেকে একজন পরিবারসহ ভারতে দেশান্তরিত হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের নাভিমূল এবং সবচেয়ে আলোচিত পর্যটন এলাকা সাজেকের রুইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে প্রতিদিন দেশের প্রায় ১০০০ মানুষের আনাগোনা হয় সে স্কুলও চলে বর্গা শিক্ষক দিয়ে।

সমাধানের পথ : সাজেক বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। বাঘাইছড়ি রাঙামাটি জেলার একটি উপজেলা। রাঙামাটি বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে বৃহত্তম একটি জেলা। সুতরাং সাজেক বাংলাদেশ ভ‚-খÐের একটি অঞ্চল। সাজেকের সহজ-সরল মানুষ বাংলাদেশেরই নাগরিক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো স্বপ্ন, কোনো লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে সাজেককে সাথে নিয়েই করতে হবে। ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি বলুন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বলুন কোনো ঘোষণা সাজেককে বাদ দিয়ে আগানো যাবে না। কাজেই, সাজেকের যে সমস্ত সমস্যা জর্জড়িত স্কুলগুলোকেও সমান তালে টেনে তুলতে হবে। তার জন্য সরকারকে যে কোনো ম‚ল্য দিতে হবে। এ কাজে আমাদের সবাইকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। কারণ এ দেশটা আমাদের সকলের জন্মভ‚মি। এ দেশটাকে আমরা ভালবাসি। আমাদের স্বদিচ্ছা থাকলে সাজেকের সেই সব স্কুলেও লাল-সবুজের পতাকা উড়ানো যাবে, সাজেকের শিশুদের মুখেও উচ্চারিত হবে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।

পপেন ত্রিপুরা: মুক্ত গণমাধ্যমকর্মী। ইমেইল:papencht1979@gmail.com ; 01752-158328